কবিতা 

মদসংখ্যা- ঋত্বিকের নতুন বাড়ি ।। জুবায়ের দুখু 

ভাঙ্গেরা,  পাবনা। কাশবন, বালুচর।

চল ভবা, পালাই। তিতাসের জলে গা ভাসিয়ে চল হারিয়ে যাই নাগরিকের কোলাহলের বাইরে- দূরে কোথাও। ঋত্বিক হারাতে চায়, লক্ষ্মীর কাছ থেকে অনেকদূর।

বুঝলে লক্ষ্মী, টাকা থাকবে না কাজটাই থেকে যাবে। তুমি দেখে নিও। তুমি দেখে নিও।

সাঁইথিয়াই টালমাটাল ঋত্বিক। হাতে বাঙলা মদের বোতল– উসকোখুসকো চুল চোখে চশমা। দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটছে কলকাতার অলিগলি। লাল সুতার কিংবা পাতার বিড়ি ফুকছেন। চারপাশ ধোঁয়ায় ছয়লাব।

নতুন বাড়ির খোঁজে ঋত্বিক চলে গেলেন সুবর্ণরেখার পাড়ে। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তারার দুঃখ নিয়ে এক জীবন অতিবাহিত করেছেন। কখনো জগদ্দলের প্রেমে হয়েছেন পাগলাটে ঋত্বিক। বাড়ি থেকে পালিয়ে জুট মিলেও কাজ করেছেন রাগের অভ্যাসে। মানুষের অভ্যাস কখনো পাল্টায় না।

ঢাকার ঋষিকেশ লেনে জন্ম নেয় ভবা সঙ্গে জমজ বোন ভবী। সেই ভবা পরে কলকাতার হাজরা রোডের উপর প্যারাডাইস ক্যাফের নোংরা চেয়ার-টেবিলে বসে আড্ডা দিত। শুনতো মৃণাল সেন সলীল চৌধুরী। সিনেমা আড্ডা গণনাট্যের আড্ডা। আরও কত জানা অজানা বিচিত্রময় আলোচনা।

ঋত্বিক মনেপ্রাণে চাইতো নাট্যকার হতে। প্রথমে অবশ্য গল্প লিখতো কিছুটা বিদ্রোহী সুরে প্রবন্ধও।

পাজামা ময়লা, পাঞ্জাবি ময়লা, উসকোখুসকো চুল। পথে পথে ঘুরছেন ঋত্বিক। হাতে বাঙলা মদের বোতল। বিড়ি ফুকছেন।

যৌবনে বামপন্থীদের রাজনীতি করতো। বোধহয় সেই থেকেই ঋত্বিক মানুষের দুঃখকে এতো কাছ থেকে চেনে। পদ্মার পাড়। ঢেউ খেলে পানি। ঋত্বিক পানিতে ঝাপ দিতে চায়। মন আনচান করে।

ভবারে তুই সব হারালি। পদ্মারপাড়ে যাবি? আয় ভবা যাই।

ওইযে দূরে কান্নার রোল পড়ে গেল। ভবা নেই। কোথায় গেল?

সে-যে এতো করে মেঘে ঢাকা তারায় বলল দাদা আমি বাঁচতে চাই। দাদা আমি বাঁচবো?

শিলং পাহাড়ের গাঁয়ে গাঁয়ে কান পেতে শোনে ঋত্বিক পাখিদের ডাক। মেঘেদের গান। যেন খোলাদুপুর। যেন পদ্মারপাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে লাফালাফি করেছে। স্টিমার যাচ্ছে। বড় নৌকা বাঁধা। নৌকার চাতালে বসে বাউল গান গাইছে।

নামাজ আমার হইলো না আদায়

কারুন ও খান্নাসের দায়।

গানের কথা ভেসে যাচ্ছে হ্যামলিনের বাঁশির সুরের মতো এপাড় থেকে ওপাড়। দুপাড়’ই যে ঋত্বিকের বাড়ি। দেশভাগ হইলো, মন ভাগ হইলো, মা ভাগ হইলো। দূর্গার এক পা এপাড় আরেক পা ওপাড়। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের মতো ঘর ছাড়লো, ভিটা ছাড়লো, নদী ছাড়লো, ছাড়লো গ্রাম প্রান্তর। পড়ে রইলো মসজিদ। পড়ে রইলো মন্দির, পড়ে রইলো মাদ্রাসা।

মানুষের দাঙ্গা বড়ই খারাপ দাঙ্গা বুঝলি ভবা। মানুষ মরে, পঙ্গু হয়, হারিয়ে যায় ক্ষোভে। অথচ পাখিদের দাঙ্গা নাই। নিজস্ব কোনো সীমান্ত নাই। সীমান্ত হইলো মানুষের বড় শত্রু। সীমান্ত না থাকলে ধর্ম থাকতো না। এর থেকেও বড় হওয়ার নেশা থাকতো না। সীমান্ত কাটাতার জেলখানার মতো। মানুষকে বন্দি রাখে। ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। ভবা ও ভবা। রাইত কত হইলো?

উত্তর মেলে না।

ঋত্বিক হাটছে। হাতে বাঙলা মদের বোতল আর মগজ বোঝাই যুক্তি তর্ক গল্পের স্ক্রিপ্ট নিয়ে। সহজ সরল ঋত্বিক। কেমন করে যে ছেলেটা গোল্লায় গেল। মা বলতেন হয়তো। রাজশাহীর কলেজিয়েটের ছাত্র থেকে হলেন কলকাতার ছাত্র। ইংলিশে স্নাতক। কোন দুঃখে সিনেমাওয়ালা হইলো বুঝি না। হয়তো পাড়ার লোকেও বলতো। ভীষণ আফসোস!

লক্ষ্মী যেতে নাহি দেব।

পাগলাটে ঋত্বিক। মাতাল ঋত্বিক। সুরমা’র সঙ্গে বিবাহ হইলো, ঘর করলো। মাথায় সিনেমাভূত, সংসার করুণ পথশিশুর মতো- চলে একরকম, চালচুলোহীন।

তিতাসের পাড়ে দাঁড়িয়ে ঋত্বিক মা দূর্গাকে এঁকেছিলেন। নাম- তিতাস একটি নদীর নাম।

তিতাস আমাদের নদী?

না ঋত্বিকের কাছে এমন নয়। বাঙালির আবার ওপাড় এপাড় আছে না-কি শুয়োরের বাচ্চা?

ঋত্বিক পদ্মার ছেলে। ঋত্বিক যমুনার ছেলে, গঙ্গার ছেলে।

নদীর এপাড়েই ভবার বাড়ি। মা পিঠা বানাতেন। কৃষক গান গাইতো। আমার লেলিনের মতো। ভবা সেইসব গানের সুরে উড়ে বেড়াতো। কিশোর ভবা, শৈশবের ভবা।

ভবা’রে ওইযে দেখ, ঘুড়ি ওড়ে। আজ কী আনন্দ।

খুকীরে তুই মাইরে ফেললি৷ একজন বাঙালি মেয়ে, দেশহারা।

ভাঙা সংসার তিলেতিলে গড়লো৷ বোনকে বিয়ে দিল নিজেরই প্রেমিকের সঙ্গে। ভাইকে গায়ক বানালো।

নীতারে তুই মাইরে ফেললি? ওরে বাড়ি থেকে বাহির কইরে দে। ওর কণ্ঠে বিঁষ।

ভবা তুই খুনী। ঋত্বিক তুই খুনী।

উদবাস্তু, ঘর নাই, বাড়ি নাই। রিফিউজি। শরনার্থী শিবিরে থাকে ঋত্বিক।

মোদের কোনো ভাষা নাই, ‘নীলকণ্ঠ বাগচী’ এবার থামো। ফ্লপ খাচ্ছে তোমার সব সিনেমা। মানুষকে কতবার কলোনির গল্প শোনাবে? দেখাবে?

ভবা মদ খায়। কখনো বা বারে বসে। কখনো মদের বোতল গিলতে গিলতে গলির রাস্তায় পড়ে থাকে।

বিটোফেন বাজে, আব্বাসউদ্দীন, রবীন্দ্রনাথ। ভবা কান পেতে শোনে।

কালো সায়র। প্রথম নাটকেই বাজিমাত।

লক্ষ্মী দশটা টাকা হবে? এই শেষ আর খাবো না। ডাক্তার দশটা টাকা দাও। না খেলে সুস্থ হবো না।

ভবা কারো কথা শোনে না। হাতে বাঙলা মদের বোতল। লাল টলমল।

লেকের পাড়ে বসে ভবা ভাবে হারিয়ে যাওয়া দিন। ময়মনসিংহ ঢাকা আর রাজশাহী পাবনার কথা। স্কুল বন্ধুদের কথা। কত আনন্দ! সব যেন ফালি-ফালি এই ভাঙা বাঙলার মতো।

লক্ষ্মী তুমি আমাকে বুঝলে না। দেখিস, আমার মৃত্যুর পর শালা এইদেশের মানুষেরা আমার কদর করবে। সম্মান জানাবে, লিখবে, গাইবে।

মাতাল ঋত্বিক, বহরামপুরে এম এ পড়তে আসা টগবগে ঋত্বিক। প্রেমে পড়লেন সুরমা’র।

সুরমা বেকার আমি, রোজগার নাই। ভবা বলে আমার সঙ্গে তোমাকে যায় না। কে শোনে কার কথা?

তিন তিনটে ছেলেপুলের বাপ অথচ সংসারে মন নেই। মদ খায়, ভাবলেশহীন, মদ খায়।

নীলকন্ঠ বাগচী কী বানাচ্ছো আজকাল কলোনীর গল্প। এসব দেখে কী লাভ বলো? সেই ঘুরেফিরে দেশভাগের ট্রাজেডি।

ভবা থামে না। আশ্রয়, আশ্রয়, আশ্রয়…

ভবা তোর বাড়ি কই? বাঙলাদেশে?

উদবাস্তু ভবা,পথের ভবা, মিথ ও মানুষের ভবা।

ভবা বিমলের এতো যন্ত্রণা কেন? জগদ্দলের সুর এত নিষ্ঠুর! প্রেম বোঝে না।

লোহালক্কড় ঝনঝন করে। ঋত্বিক বাড়ি খোঁজে। রামকিংঙ্করের সঙ্গে সিগারেট খায়, মদ ও খায়। পথে পড়ে থাকে। পাড়মাতাল ভবা।

পাগলাগারদে ভবা নাটক লেখে আবার।

পাগলদের অভিনয়।

শান্ত নদীর মতো ভবা হাসে, হাসিতে রাজমিশন নড়ে ওঠে। হাসিতে গণতন্ত্র কাঁপে।

রোজ ক্যালেন্ডার দাঁগায় ভবা, রাতে বেহালাবাদকের বাঁশীর সুরে ঘুমিয়ে পড়ে।

চারপাশে হতাশা, হতাশা আর হতাশা…

লক্ষ্মী সাঁইথিয়া থাকে। ভবা মদ খায়। ঘটিবাটি বেচে। ভবা মদ খায়। সমুদ্র সমান মদ খায়।

Related posts